সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী বারি সূর্যমুখী মাড়াইযন্ত্র উদ্ভাবন
ড. মোহাম্মদ এরশাদুল হক
সূর্যমুখী আমাদের দেশে একটি গৌণ তেল ফসল কিন্তু এটি বিশ্বের দ্বিতীয় ভোজ্যতেল ফসল। আলোক ও তাপমাত্রা অসংবেদনশীলতার জন্য এটি বাংলাদেশে রবি ও খরিপ দুই মৌসুমেই চাষ করা যায়। দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে সূর্যমুখী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। প্রতি বছর দেশে তেল/তেলবীজের ঘাটতি পূরণের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে তেল/তেলবীজ আমদানি করতে হয়। আমদানির পরিমাণ কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা বাচাতে হলে আরোও বেশি তেলবীজ ফসলের চাষ করতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তেলবীজ গবেষণা কেন্দ্র সূর্যমুখীর বেশ কয়েকটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। ফসলটি আমাদের দেশের উত্তরবঙ্গে রোপা আমন কাটার পর সহজেই চাষ করা যায়। এছাড়া লবণাক্ততাসহিষ্ণু বৈশিষ্ট্য আছে বলে উপকূলীয় এলাকায়ও এর চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তেলের গুণাগুণের দিক থেকে সূর্যমুখী তেল অন্যান্য ভোজ্যতেলের চেয়ে উন্নত। এ কারণে এ ফসলের চাষ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সূর্যমুখীর বীজ হতে উৎকৃষ্টমানের ভোজ্যতেল পাওয়া যায়। সূর্যমুখীর বীজে শতকরা ৪০-৪৫ ভাগ তেল আছে। ঘানির সাহায্যে গড়ে শতকরা ৩০-৩৩ ভাগ এবং এক্সপেলারের সাহায্যে ৩৩-৩৮ ভাগ তেল নিষ্কাশন করা যায়। বীজ ছাড়ানোর পর মাথাগুলো গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। খৈলে শতকরা ৪-৬ ভাগ নাইট্রোজেন থাকে বলে এটি একটি উৎকৃষ্ট জৈবসার। খৈলের ভেষজ গুণও রয়েছে। ফসল কর্তনের পর সূর্যমুখীর গাছ ও পুষ্পস্তবক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতসব সুবিধার পরেও যে সব কারণে সূর্যমুখী চাষ বাংলাদেশে প্রসার লাভ করেনি তার মধ্যে একটি হলো হাতে মাড়াই করা। সূর্যমুখী বপনের ৬৫-৭০ দিন পরে ফুলের বীজ যখন পুষ্ট হয় তখন গাছ থেকে পুষ্পস্তবক সংগ্রহ করে রোদে ২/১ দিন ছড়িয়ে দিতে হবে। এসময় মাথাগুলো কিছুটা নরম হয়ে যায় তখন শক্ত বাশের বা কাঠের লাঠি দিয়ে সূর্যমুখীর মাথার পেছনে আঘাত করলে বেশির ভাগ বীজ ঝরে পড়ে। অবশিষ্ট বীজ হাত দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে হয়। এভাবে একটা একটা করে পুষ্পস্তবক হাতে মাড়াই করা যেমন সময় সাপেক্ষ তেমনি কষ্টকর। সূর্যমুখীর দানা বের করে আনতে এ কারণে খরচও বেড়ে যায়। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে প্রান্তিক কৃষকের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ একটি শক্তিচালিত সূর্যমুখী মাড়াইযন্ত্র উদ্ভাবন করেছে।
যন্ত্রটির বৈশিষ্ট্য : যন্ত্রটি স্থানীয় প্রকৌশল কারখানায় তৈরি করা যায়। যন্ত্রটি চালানোর জন্য একজন লোকই যথেষ্ট। বাছাইকৃত সূর্যমুখী দিয়ে উচ্চমাত্রার ফলাফল পাওয়া যায়। মাত্র ৪.৫ অশ্বশক্তির ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে যন্ত্রটি চালানো যায়। মাঠ থেকে পরিপক্ব সূর্যমুখীর হেড সংগ্রহ করে সাথে সাথেই এই যন্ত্র দ্বারা মাড়াই করা যায়। এমএস অ্যাঙ্গেলবার, এমএস রড, এমএস শীট, এমএস ফ্লাটবার, এমএস রোলার, ভি-পুলি, বিয়ারিং ইত্যাদি দিয়ে যন্ত্রটি তৈরি।
যন্ত্রের বিবরণ : যন্ত্রটি ইঞ্জিনচালিত মাড়াইযন্ত্র। দৈর্ঘ্য ১৫০০ মিমি.; প্রস্থ ১৩০০ মিমি.; উচ্চতা ১৫০০ মিমি.; ওজন ১২৫ কেজি (ইঞ্জিন ছাড়া); মাড়াই রোলারের গতিবেগ ৩৫০-৪০০ আরপিএম; হপারের ধারণক্ষমতা ১০-১৫ কেজি; কার্যকরী ক্ষমতা ৬০০-১০০০ কেজি/ঘণ্টা; বর্তমান বাজারমূল্য টাকা ৫০০০০.০০ (ইঞ্জিন ছাড়া)। যন্ত্রটির মাড়াইয়ের কার্যক্ষমতা ৬০০-১০০০ কেজি/ঘণ্টা এবং দানা ভাঙ্গার হার ০%।
কার্যপ্রণালী : যন্ত্রটি ব্যবহারের জন্য একটি পরিষ্কার ও সমতল স্থান নির্বাচন করতে হবে। বেল্টের সাহায্যে ডিজেল ইঞ্জিনের সাথে যন্ত্রটিকে সংযোগ দিতে হবে। ইঞ্জিন চালু করলে যন্ত্রটি চালু হবে। যন্ত্রের মাড়াই চেম্বারে সিলিন্ডারের ঘূর্ণন ও তাতে পেগের (দ-) আঘাতে বীজ ছাড়ানোর কাজ হয়ে থাকে। যন্ত্রের উপরের হপারের সংরক্ষিত পুষ্পস্তবকগুলো নিচের হপারে নিয়ে আস্তে আস্তে প্রবেশ পথ দিয়ে প্রবেশ করাতে হবে। ক্রমাগত আঘাত ও ঘর্ষণে পুষ্পস্তবক থেকে দানাগুলো আলাদা হয়ে নিচের দিকে পড়বে। নিচের দিকে পড়ার সময় চালুনির মাধ্যমে দানা থেকে অপদ্রব্যগুলো আলাদা হয়ে যাবে। যন্ত্রটি প্রতিবার ব্যবহারের আগে ও পরে অবশ্যই ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এফএমপি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২৬৩৫৫০৩ ই-মেইল : ধৎংযধফঁষভসঢ়ব@মসধরষ.পড়স